সম্প্রতি ভারত চাঁদের দক্ষিণমেরু অঞ্চলে চন্দ্রযান-৩ অবতরণের মাধ্যমে ইতিহাস রচনা করে। একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে এমন কঠিন একটি কাজ করতে পারার জন্য ভারতের বিজ্ঞানী আর নীতিনির্ধারকদের অভিনন্দন জানাই।
চন্দ্রযান-৩ অবতরণের পর থেকেই এ নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশে। আমার কাছে ব্যাপারটি খুবই ইতিবাচক মনে হয়েছে। এই আলোচনার মাঝে বাংলাদেশের মানুষের এগিয়ে যাবার প্রত্যয় প্রকাশ পায়। সাবাস বাংলাদেশ!
এ বিষয় নিয়ে অনেকেই আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। বিক্ষিপ্তভাবে পয়েন্ট আকারে কিছু কথা বলছি। তবে পড়ার সময় মনে রাখবেন যে, আত্মসমালোচনা ছাড়া আত্মশুদ্ধি বা নিজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কেউ আঘাত পেলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। প্রথমে শুরু করছি ভারতের মহাকাশ অভিযান নিয়েঃ
১/ রকেটবিদ্যা খুবই জটিল একটি বিদ্যা। এর আগে চাঁদে গেলেও আমেরিকা এখনও এ বিষয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে। অনেক বছর কাজের পর NASA’র আর্টিমিস প্রোগ্রামের মাধ্যমে আবারও চাঁদে মানুষ পাঠাচ্ছে আমেরিকা। প্রযুক্তিগতভাবে বিষয়টি কতটা জটিল তা বলে বোঝানো কঠিন। আমেরিকা তাই রকেট বিজ্ঞানীদের national treasure বা জাতীয় সম্পদ বলে থাকে। এই গত সপ্তাহেই রাশিয়ার লুনা-২৫ যানটি চাঁদের বুকে ধ্বংস হয়ে যায়। লুনা-২৫ এর অভিযানটির উদ্দেশ্য ভারতের চন্দ্রযান-৩ এর অনুরূপই ছিল। বলে রাখা ভাল, রাশিয়া প্রথম দেশ হিসেবে মহাকাশে মানুষ পাঠিয়েছিল (ইউরি গাগারিন)। রকেটবিদ্যায় তারা দানবাকার হওয়া সত্ত্বেও তাদের অভিযানটি সফল হয়নি। কাজেই ভারতের এই সাফল্যকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
২/ ভারত চন্দ্রযান আর মঙ্গলযানগুলো নিজেদের রকেট দিয়ে উৎক্ষেপণ করেছে। ১৯৬৩ সালে ভারত তাদের প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ করে কেরালার তুমবা নামক একটি গ্রাম থেকে। এই রকেটটির বিভিন্ন অংশ সাইকেলে করে নিয়ে যাওয়া হয় জোড়া দেয়ার জন্য। ছোট্ট একটি গবেষকদের দল দিয়ে এই রকেটটি তৈরি হয়। তখন কিন্তু ভারত কোন পরাশক্তি ছিল না। আর আজ ভারত চাঁদ এবং মঙ্গলে একাধিক যান পাঠাচ্ছে। এখানে ভারতের নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৩/ ভারতের ISRO এর বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীরা কিন্তু বেশিরভাগই ভারতেই পড়াশোনা করেছেন। আবার শুধুমাত্র বিশ্ববিখ্যাত IIT বা IISc তে নয়, উনাদের তৈরিতে সাধারণ বিশ্ববিদ্যায়গুলোর অবদানই বেশি। উদাহরণস্বরূপ চলে আসে টিকেএম কলেজ অব্ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতীদশন বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নাম, যেগুলোর বেশিরভাগই আমাদের কাছে অজানা। এর দ্বারা এটিই প্রতীয়মান হয়ে যে, ভারতের সর্বস্তরে ভাল শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এ বছর ভারতের একটি ছোট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে টক দিতে গিয়ে এমনটিই দেখেছি। সেই সাথে দেখেছি শিক্ষক আর গবেষকদের কতটা সম্মান করা হয় ভারতে। আর যোগ্যতা ও পদমর্যাদা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া হয় সেখানে।
৪/ চন্দ্রযান-৩ প্রকল্পে সরাসরি কাজ করেছেন প্রায় ১০০০ প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী। এদের মাঝে অনেকেরই আছে রকেটবিদ্যার জটিল জটিল বিভিন্ন বিষয়ে পিএইচডি। বিশ্বমানের এই পিএইচডিগুলোর বেশিরভাগ ভারতেরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে করা।
৫/ চাঁদের দক্ষিণমেরু অঞ্চলটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। সহজ ভাষায়, সেখানে সূর্যের আলোর স্বল্পতার কারণে তাপমাত্রা কম। বিশেষ করে সেখানকার বড় বড় গর্তে (crater) সূর্যের আলো একেবারেই পৌঁছায় না, যার দরুণ সেখানকার তাপমাত্রা এতটাই কম যে, সেখানে বরফ আকারে পানি থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি। যদি বিপুল পরিমানে বরফ থেকে থাকে, তাহলে তা থেকে যেমন মানুষের বসবাসের জন্য পানি তৈরি করা যাবে, তেমনি সেই পানি ভেঙে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আলাদা করে জ্বালানী তৈরি করা যাবে। পৃথিবী থেকে আসা রকেটগুলি চাঁদে এসে এই জ্বালানী ব্যবহার করে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। এই বরফের কোন অস্তিত্ব আছে কিনা, তা নির্ণয় করাই চন্দ্রযান-৩ এর মূল উদ্দেশ্য। এই নতুন তথ্যগুলো বিজ্ঞানের জন্য একটি মাইলফলক। বিশ্বের মুক্ত বিজ্ঞানের প্রতি এটি ভারতের বিশাল একটি অবদান। এ ধরণের প্রকল্প বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রকল্প।
এবার আসুন, এ বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলিঃ
ক) ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ থেকে অবশ্যই রকেট উৎক্ষেপণ সম্ভব। ইউরোপ বা এশিয়ার অনেক দেশেরই এমন সুন্দর ভৌগলিক অবস্থান না থাকায় তারা রকেট উৎক্ষেপণ করতে পারে না। মূলত নিরক্ষরেখার কাছাকাছি অবস্থিত দেশগুলি এই সুযোগটি পায় (পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির একাংশ ব্যবহার করতে পারে রকেটটি)। তবে আমাদের দেশের নিজস্ব রকেট প্রয়োজন আছে না নেই, তা অবশ্যই আলোচোনার বিষয়।
খ) ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলোর মত আমাদের উচিৎ বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ও ছোট ছোট মহাকাশ যান তৈরি করা, যা সরাসরি আমাদের দেশের স্থল ও সমুদ্র পর্যবেক্ষন করতে সাহায্য করবে। এগুলো উৎক্ষেপণ করা যেতে পার অন্য দেশ থেকে। এও যদি সম্ভাব না হয়, অন্যান্য দেশের কাছ থেকে তথ্য কিনে বা বিনামূল্যে নিয়ে গবেষণা করা উচিৎ। ছোট দেশ বলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকতে হবে, এমনটি ভাবা অনুচিত। ভারত কিন্তু NASA, DLR, Max Plank Institute এর মত সংস্থার সাথে কাজ করে আসছে বহু বছর ধরে। এমন কাজ আমরাও করতে পারি।
গ) যারা ভাবছেন বাংলাদেশের জন্য (ক) এবং (খ) অপ্রয়োজনীয়, তাদের জন্য এই পয়েন্টটি। আমরা যদি আরও ৫০ বছর পর আমাদের নিজস্ব রকেট প্রকল্প বা অন্যান্য প্রযুক্তিগত প্রকল্প চাই, তাহলে এখনই মানসিকতার পরিবর্তন এবং দেশের সর্বস্তরে শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হবে। তা না হলে ৫০ বছর পরও বিদেশি স্যাটেলাইট কিনে বিদেশি রকেটে পাঠিয়েই আমাদের মহাকাশ জয়ের স্বাদ নিতে হবে।
ঘ) আমাদের দেশের সেরা সন্তানদের সিংহাংশ হয় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। তবুও আমাদের দেশে ছোট-বড় প্রতিটি প্রকল্প দেয়া হয় বিদেশিদের (ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ইত্যাদি)। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হচ্ছে দেশে অথচ বেকার বসে আছে আমাদের মেধাবীরা। এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় সত্যিই আর নেই। এই একই টাকা খরচ করে আমাদের দেশে জনবল তৈরি করলে আজ আমাদের সেই প্রকল্পগুলোও হত এবং একই সাথে এখন আমরা অন্যান্য দেশে গিয়ে তাদের প্রকল্পগুলো করে আসতে পারতাম (চীন এখন যা করছে)। আয় হত বিদেশি মুদ্রা।
ঙ) স্পারসো প্রসঙ্গেঃ এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কে বা তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা কী তার চেয়ে বড় প্রশ্ন প্রতিষ্ঠার এত বছর পর স্পারসোর গবেষণায় অবদান কী? মাঝারি মানের কোন গবেষণাপত্র বা প্রকল্প আছে কী? স্পারসোর ওয়েবসাইটে ২০১৯ থেকে ২০২৩ অর্থ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের অনুমোদিত বাজেট উল্লেখ করলেও গবেষণার কোন ফলাফল (যেমন গবেষণাপত্র) দেয়া হয়নি। এগুলো প্রকাশ করা যেকোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। আর জনবলের অভাবের কথাটি আমি মানতে নারাজ। বাংলাদেশে যথেষ্ঠ ভাল মানের প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী আছে। গবেষণাকেন্দ্রে নিয়েগ হবে লব্ধ গবেষণা ভিত্তিতে। অন্য কোন উপায়ে নয়। দেশের গবেষণাকেন্দ্রগুলোর অবদান নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতেই পারেন। স্বয়ং NASA-ও আমেরিকানদের জবাবদিহিতার বাহিরে নয়।
চ) মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত খনিজ সম্পদে ভরপুর নয় বাংলাদেশ। ওদের মত ক্রেতাগোষ্ঠি হলে চলবে না আমাদের। ডলার সংকটের মাঝে কোটি টাকার সরকারি গাড়ি কেনার দৃশ্যই আমাদের বর্তমান অবস্থার সুন্দর চিত্রায়ণ করে দেয়। আবার আমরা লাখ টাকার ফোন কিনব অথচ ২০০ টাকা দিয়ে বই কিনব না। অথবা বিয়েতে ২৫-৩০ লক্ষ টাকা খরচ না করে সেই টাকায় বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মাস্টার্স করে আসা যায় – তা চিন্তা করব না। এই আচরণগুলো আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সব পর্যায়ই দেখা যায়। অথচ আমাদের মত জনবহুল দেশের মানুষের হওয়া প্রয়োজন জ্ঞাননির্ভর একটি জাতি। প্রয়োজন শিক্ষার ব্যবস্থায় বিনিয়োগ। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী খুব সুন্দর করে বলেছিলেনঃ জীবন হবে সহজ, চিন্তা হবে জটিল।
ছ) আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোথাও তেমন কোন গবেষণা করা হয় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গবেষণার হাত হয় পিএইচডি আর পোস্টডক পর্যায়ের গবেষকগণ। আমাদের দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কয়টি পিএইচডি করানো হয়? ভারতের অনেক ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ভাল মানের পিএইচডি করানো হয়। আমাদের উচিৎ দেশের সেরা মেধাবীদের ভাল পরিমানের বৃত্তি দিয়ে দেশেই পিএইচডি করানো। সরকারের বিভিন্ন জটিল প্রকল্পের সমাধানও এর মধ্য দিয়ে চলে আসতে পারে। বিদেশের অনেক প্রকল্পই এভাবে হয়ে থাকে। শিক্ষা ও বিজ্ঞানে বিনিয়োগ অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, সেগুলোর মানও বাড়াতে হবে। শুধুমাত্র কৃষি আর তৈরি পোষাক শিল্পে ভাল হলেই হবে কি?
জ) বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের যে মান, তাতে অবদান রাখতে হলে গবেষণার জন্য গবেষকদের নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের দেশে এখনও অতীতের মত কেবল স্নাতক আর মাস্টার্সের পরই স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বেশ হাস্যকর। ভারতের ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক (এরা আসলে গবেষক) হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে ভাল পিএইচডির পাশাপাশি তিন বছরের পোস্টডক প্রয়োজন হয়। সাথে গবেষণাপত্র তো লাগবেই। পিএইচডি হচ্ছে কেবল গবেষণা করার ট্রেনিং মাত্র। গবেষণা করার prerequisite বলা চলে। আর আমাদের দেশে এখনও পিএইচডি ছাড়াই গবেষক পদে নিয়োগ হয়। ইউরোপ-আমেরিকা না হোক, পাশের দেশ থেকে তো কিছু হলেও শেখা যায়।
আসা করি উপরিউক্ত পয়েন্টগুলি আপনাদের এ বিষয়ে নিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে। আসুন একটি শিক্ষিত ও জ্ঞাননির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন গড়ি। অজুহাতের বার হাত তো থাকবেই। ভারতেরও আমাদের মত হাজারটা সমস্যা আছে। আবার আমাদেরও ওদের মত মেধাবী আছে। ভারতের কাছ থেকে হিন্দি বা বলিউড গান ছাড়াও আরও অনেক কিছুই শেখার আছে। প্রয়োজন শুধু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
আপনাদের প্রশ্নগুলো খুবই যৌক্তিক। আরও প্রশ্ন করবেন। আমরা যদি ভারতে সাথে আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে তুলনা করতে পারি, তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনা কেন নয়?
হাসান সাদ ইফতি, পিএইচডি (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়)
ডিপার্টমেন্ট অব্ এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং,
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
ছবিঃ নাসা/বিবিসি
0 Comments